বিশাল বড় বাহিনীকেও যে কার্যকর ইন্টেলিজেন্স দিয়ে খুব সহজে ধসিয়ে দেওয়া যায়, হেজবুল্লাহ এবং ইরানের উপর ইসরায়েলের আক্রমণের বাইরেও এর সাম্প্রতিক আরেকটা উদাহরণ ছিল বাশার আল-আসাদের পতন।
বাশার আল-আসাদের নাটকীয় এবং অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে পতনের পেছনে অনেকে অনেক ধরনের কারণ ব্যাখ্যা করেছে। কিন্তু সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং আলোচনাটা এসেছে সিরিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট কামাল শাহীনের লেখায়।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই সিরিয়ান সেনাবাহিনীর অফিসারদের দ্বারা ব্যবহৃত টেলিগ্রাম গ্রুপের মাধ্যমে তাদের মধ্যে একটা মোবাইল অ্যাপ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে - STFD-686।
STFD এর পূর্ণরূপ হচ্ছে Syria Trust for Development। এটা ছিল বাশারের ওয়াইফ আসমা আসাদ কর্তৃক পরিচালিত একটা মানবিক সহায়তামূলক সংস্থা। সিরিয়ানরা এই নামের সাথে আগে থেকেই পরিচিত ছিল।
অ্যাপটার ডিজাইন করা হয় আসল STFD-এর লগো ব্যবহার করে। অ্যাপের ইনফোতে গেলে যে ওয়েবসাইটে রিডাইরেক্ট হয়, সেটাও STFD-এরই ওয়েবসাইট। ফলে ব্যবহারকারীদের সন্দেহ করার কোনো কারণ ছিল না যে অ্যাপটা ফেক হতে পারে। তাছাড়া বাশার বা আসমার নাম যেখানে জড়িত, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহসই বা কয়জনে রাখে?
অ্যাপটার উদ্দেশ্য ছিল খুব নিরীহ। সেনা অফিসারদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। অ্যাপে দেওয়া কোয়েশ্চেনিয়ার পূরণ করলে, এবং অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ দিলে মাসে ৪০ ডলার করে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হবে।
STFD আগে থেকেই এ ধরনের কার্যক্রমের জন্য পরিচিত ছিল। তাছাড়া দীর্ঘ এক যুগের গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার মূল্যস্ফীতি কয়েকশত গুণ বেড়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের আগে ১ মার্কিন ডলার যেখানে ছিল ১৫ সিরিয়ান লিরা, সেখানে ২০২৪ সালে ১ ডলার সমান হয়ে গিয়েছিল ১৫ হাজার লিরা!
সেনা অফিসারদের অর্থনৈতিক অবস্থাও সাধারণ নাগরিকদের চেয়ে খুব বেশি ভালো ছিল না। তাদের গড় বেতন ছিল মাত্র ২০ ডলারের সমান। ফলে ফার্স্ট লেডি যখন অতিরিক্ত ৪০ ডলার করে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, শুধুমাত্র অফিসারদের পরিবারের জন্য, তখন অফিসাররা সেটা লুফে নেয়।
আর্থিক সাহায্য পাওয়ার জন্য অ্যাপটাতে অফিসারদেরকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য পূরণ করতে হয় - নাম, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, তাদের নাম-পরিচয়, অর্থনৈতিক অবস্থা, বর্তমান মিলিটারি র্যাঙ্ক, বর্তমান অবস্থান - সব। আর এই সব তথ্য পূরণ করার মধ্য দিয়ে অফিসাররা স্বেচ্ছায় তাদের সব তথ্য তুলে দেয় অ্যাপের নির্মাতাদের হাতে।
শুধু এটাই না, অ্যাপটা ইনস্টল করার সাথে সাথে ব্যাকডোর দিয়ে SpyMax নামের একটা স্পাইওয়্যারও মোবাইল ফোনে ইনস্টল হয়ে যেত। সেই স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর লাইভ লোকেশন, কল লগ, ম্যাসেজ টেক্সট - সব চলে যেত নির্মাতাদের হাতে।
৪০ ডলারের জন্য সিরিয়ান আর্মির অফিসারদের অনেকেই তাদের ফোনে অ্যাপটা ইনস্টল করেছিল। এবং এর ফলে নির্মাতাদের কাছে তাদের প্রত্যেকের অবস্থান, অর্থাৎ তাদের অধীনস্থ ইউনিটের অবস্থান, তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা - সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়।
এবং ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহীরা যখন তাদের অভিযান শুরু করে, তখন দেখা যায় তারা সবজান্তার মতো সিরিয়ান সেনাবাহিনীর অবস্থানগুলো এড়িয়ে মাঝখান দিয়ে ঢুকে পেছন থেকে অ্যাম্বুশ করে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। অন্য একাধিক কারণের পাশাপাশি বাশার আল-আসাদের আকস্মিক পতনের পেছনে এই ইন্টেলিজেন্স অপারেশনও নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
সাইবার ওয়ারফেয়ার যে পর্যায়ে গেছে, আমাদের কোনো তথ্যই আর গোপন রাখার উপায় নাই। যারা নিজেদের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে না পারবে, শত্রুর উপর কনস্ট্যান্ট গুপ্তচরবৃত্তি না চালাবে, নিজেদেরকে সিকিউর করার সর্বোচ্চ চেষ্টা না করবে, যত বড় সেনাবাহিনীই থাকুক, শুরুতেই তারা বিশাল একধাপ পিছিয়ে যাবে।
© www.newsnewstbd.com
নিউজনেস্ট