
চলন্ত ট্রেন থেকে একজনকে ফেলে দেওয়ার ভাইরাল ভিডিওর পেছনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তি। তিনি মতিউর রহমান (৪০)। তিনি জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা করেন। মতিউর জানান, পূর্ববিরোধের জের ধরে ট্রেনে মুঠোফোন চুরির অভিযোগে তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন কয়েকজন যুবক। ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছেন।
চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে আহত মতিউর রহমান বর্তমানে নওগাঁর রানীনগর উপজেলার পাড়ইল ফকিরপাড়া গ্রামের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেদিন তার সঙ্গে ট্রেনে কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মতিউর রহমান জানান, শনিবার (১৭ মে) তিনি বগুড়ায় মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পরদিন রোববার মেয়ের বাসা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফেরার জন্য বেলা ১১টার দিকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে যান। স্টেশনে চা খাওয়ার সময় মাস্ক পরা দুই যুবক তার সামনে এসে দাঁড়ান। দুপুর ১২টার দিকে ট্রেন এলে মতিউর ট্রেনের যে বগিতে ওঠেন, ওই দুই যুবকও সেই বগিতে ওঠেন। সেদিন ট্রেনে তেমন ভিড় ছিল না। ট্রেন তালোড়া স্টেশনে এলে অনেক যাত্রী নেমে পড়ায় ওই বগি আরও ফাঁকা হয়ে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর মাস্ক পরা দুই যুবক মতিউরের পাশে এসে বসেন। তারা তার কাছে বাসার ঠিকানা এবং অন্যান্য বিষয় জানতে চান। সেগুলোর উত্তর দেন মতিউর। এরপর চলে যান দুই যুবক।
মতিউর রহমান আরও বলেন, ‘তখনো বুঝতে পারিনি, ওরা আমাকে মারার জন্য ফলো করছে। ট্রেন আলতাফনগর স্টেশনে থামলে সেখানে মাস্ক পরা আরও পাঁচ যুবক আমাদের বগিতে ওঠে। ট্রেন আলতাফনগর ছাড়ার পর সাত যুবক আমাকে মারতে শুরু করে। ট্রেনের অন্য লোকজন কেন মারছে জানতে চাইলে ওরা বলে, আমি নাকি ওদের কাছ থেকে দুটি মোবাইল চুরি করেছি। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে একজনের মুখের মাস্ক আমি টান মেরে খুলি ফেলি। ওকে চিনে ফেলায় ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে মেরে ফেলবে। প্রথমে আমাকে মারার জন্য চাকু বের করে। পরে ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে মারবে। একপর্যায়ে তারা আমাকে চাকু মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিতে চায়। তাদের মধ্যে থাকা একজন তখন বলেন, “চাকু মারলে আমরা ফেঁসে যাব, একে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিই, তাহলে মানুষ ভাববে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।” এ বলে তারা আমাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন আমি ট্রেনের দরজার রড ধরে ঝুলে বাঁচার চেষ্টা করি। এ সময় তারা আমাকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য ধাক্কা দিতে থাকে। এভাবে আলতাফনগর স্টেশন থেকে নশরতপুর পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ মিনিট আমি ঝুলে ছিলাম।’
ঘটনার বর্ণনায় মতিউর আরও বলেন, ‘ট্রেন নশরতপুর স্টেশনে পৌঁছালে আমি প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ট্রেনের নিচে পড়ে যাই। স্টেশনে থাকা লোকজন আমাকে কুঁজো হয়ে থাকতে বলেন। আমি তাদের কথা শুনে তখন সেভাবেই থাকি। আল্লাহর রহমতে কোনো রকমভাবে প্রাণে বেঁচে যাই। ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে আমার পিঠ ও পায়ের অনেক জায়গা ছিলে গেছে। আহত হয়ে আমার অবস্থা মৃতপ্রায়। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। খবর পেয়ে আমার স্ত্রী-সন্তানেরা এসে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
মতিউর যাকে চিনতে পেরেছেন, তার নাম সুমন (৩০)। তিনি আদমদীঘি উপজেলার দহরপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে। সুমনের ভগ্নিপতি আদমদীঘির তালসন গ্রামের সজীব মতিউরের মাধ্যমে সৌদি আরবে যান। সৌদি আরবে গিয়ে সজীবের কাজ পেতে সমস্যা হওয়ায় তার পরিবার মতিউরকে দোষারোপ করে আসছে। মতিউরের দাবি, এ বিরোধের জেরেই সজীবের শ্যালক সুমনের নেতৃত্বে চুরির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ট্রেনে তাকে (মতিউর) মারধর ও পরে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
গত রোববার দুপুরে সান্তাহারগামী চলন্ত ট্রেনে মতিউর রহমানের ঝুলে থাকা ও ট্রেন থেকে পড়ে যাওয়ার ৩৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ঘটনা নিয়ে গতকাল সোমবার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চাইলে সৌদিপ্রবাসী সজীবের বাবা হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘৪০ দিন আগে সজীবকে মতিউরের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত আমার ছেলে কাজের সুযোগ পায়নি। এ নিয়ে তার সঙ্গে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছি। সে আমার সঙ্গে দেখা না করে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। সাত থেকে আট দিন আগে তার বাড়িতে আমরা গিয়েছিলাম ছেলের বিষয়ে জানতে, তবে সেখানে কোনো ঝামেলা হয়নি। রোববার মতিউরের সঙ্গে ট্রেনে কী ঘটেছে, এর সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা
এদিকে ট্রেনে মারধর ও চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় মতিউর রহমান বাদী হয়ে গতকাল রাতে সান্তাহার জংশন জিআরপি থানায় মামলা করেছেন। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ডহরপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে সুমনকে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ছয়-সাতজনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মতিউর রহমানের মাধ্যমে কিছুদিন আগে সজীব নামের এক যুবক সৌদি আরবে যান। কিন্তু সৌদি আরবে যাওয়ার পর কাগজপত্রে সমস্যা থাকায় ইকামা (কাজের সুপারিশ সনদ) না পাওয়ায় সজীবের পরিবারের সঙ্গে মতিউর রহমানের বিরোধ তৈরি হয়। এর জেরে সজীবের নির্দেশে কয়েকজন যুবক গত রোববার মতিউর রহমানকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন।
সান্তাহার রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাবিবুর রহমান বলেন, ওই ঘটনার পর মামলা করা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।