
- কচ্ছপিয়ায় আছে ছয় বন্দিশালা
- দুই বছরে ৫০০ ভিকটিম উদ্ধার
- তথ্যদাতাদের হত্যাও করছে পাচারকারীরা
নাফ নদের পূর্বে মায়ানমারের রাখাইন (আরাকান) ও পশ্চিমে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় অস্থিরতা চলছেই। কোথায় ঠাঁই হবে বাস্তুচ্যুত এই মানুষগুলোর—এমন উদ্বেগ তাদেরই সবচেয়ে বেশি কুরে কুরে খাচ্ছে। দিনের পর দিন হতাশার আগুন তাদের পোড়াচ্ছে। বুকভরা হতাশা নিয়ে তাদের অনেকে রাতের আঁধারে অথৈ সাগরে পাড়ি দেয়, যদি কোথাও গিয়ে ভালোভাবে জীবনের বাকি সময়গুলো পার করা যায়! রোহিঙ্গাদের এই হতাশাকে পুঁজি করে বাণিজ্যে নেমেছে টেকনাফ সীমান্তের কমপক্ষে ১৫টি চক্র।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তেই মানবপাচারে জড়িত আছে ১৫টি চক্র। এসব চক্রের সব মিলে সদস্য আছে তিন শতাধিক। তারা নাফ নদের এপার-ওপারে সক্রিয়। তারা শুধু যে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে বাণিজ্য চালাচ্ছে তা নয়, বাংলাদেশিদের কাছেও তারা নানা কৌশলে ভেড়ে।
সূত্র জানায়, পাচারকারীদের চক্রে বাংলাদেশি যেমন আছে, তেমনি আছে রোহিঙ্গারাও। তারা মিলেমিশে চক্র গড়ে পাচারকাজ চালিয়ে আসছে। রাখাইন রাজ্যে থাকা পাচারকারীদের নিয়োজিত দালালরা সরাসরি রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের এনেই টেকনাফের মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন বাহারছড়া ইউনিয়নের পাচারের পয়েন্ট দিয়ে নৌযানে তুলে দেয়। রাখাইনে থাকা ‘রোহিঙ্গাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই’—এ রকম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা ছড়িয়ে তাদের হতাশা বাড়িয়ে পাচারের জন্য উৎসাহিত করে দালালরা। একইভাবে টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্প থেকেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে নৌকায় তুলে দেওয়া হয়।
কচ্ছপিয়ায় ছয় বন্দিশালা : অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন পাঁচটি পয়েন্টই মানবপাচারের অন্যতম প্রধান পয়েন্ট। এগুলো যথাক্রমে কচ্ছপিয়া করাচিপাড়া নৌঘাট, বড় ডেইলপাড়া ঘাট, শামলাপুর ঘাট, হাবিরচড়া ঘাট ও নোয়াখালীপাড়া ঘাট। এসব নৌঘাট দিয়ে সবচেয়ে বেশি মানবপাচার হয়ে থাকে। পাচার হওয়ার পর ধরা পড়লে অনেক ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছে, বাহারছড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কচ্ছপিয়া গ্রামেই পাচারকারী চক্রের বিশাল আস্তানা আছে। পাহাড়ঘেঁষা এই গ্রামে আছে কমপক্ষে ছয়টি বন্দিশালা। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে নিয়ে আটক করে রাখা হয় এসব বন্দিশালায়। টেকনাফ থানা পুলিশ গত জানুয়ারিতে অভিযান চালিয়ে বন্দিশালা থেকে পাচারের জন্য আটকে রাখা কয়েকজন রোহিঙ্গাসহ ১৬ জনকে উদ্ধারও করেছিল।
পাচারকারীদের হাতে তিন মাসে দুজন নিহত : টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া গ্রামের সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারীদের হাতে গত তিন মাসে দুই ব্যক্তি নিহত হন। পাচারকারীদের দাবি অনুসারে, টাকা না দেওয়ায় গত ১৭ জানুয়ারি নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন রহমতুল্লাহ। তিনি কক্সবাজারের রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। নিহতের স্ত্রী ছবুরা খাতুন এ ব্যাপারে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। পরে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে। গত ২২ মার্চ মোহাম্মদ রাসেলকে (২৫) রাতে ঘর থেকে তুলে নিয়ে মানবপাচারকারীর দল হত্যা করে। নিহত রাসেলের স্ত্রী জেসমিন আকতার এ ব্যাপারে টেকনাফ থানায় ১১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। নিহতের স্ত্রীর অভিযোগ—গ্রামটির সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারীদের নানা গোপন তৎপরতার তথ্য আইন-শৃংখলা রক্ষা সংস্থাগুলোর সদস্যদের জানানোয় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
টেকনাফের ১৫ চক্র : সূত্র জানায়, কক্সবাজারের টেকনাফে ১৫টি চক্রের তিন শতাধিক সদস্য মানবপাচারে সক্রিয় রয়েছে। সবচেয়ে বড় পাচারকারী বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া গ্রামের কেফায়েত উল্লাহ গত দুই মাস আগে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সে কারাগারে রয়েছে। তার চক্রের সদস্য কমপক্ষে ৩০ জন। তাদের আবার বেশির ভাগই অবৈধ অস্ত্রধারী। মো. কেফায়েত টেকনাফ থেকে পাচারের চালান পাঠায় মালয়েশিয়ায়, আর মালয়েশিয়ায় সেই চালান গ্রহণের জন্য রয়েছে তারই ছোট ভাই সাইদুল করিম শাহী। শাহী মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিদের নিয়ে গড়ে তুলেছে বড় চক্র।
টেকনাফের বাহারছড়ায় কেফায়েত ছাড়াও রয়েছে সৈয়দুল হক এবং ফারুকের চক্র। এ ছাড়া আছে রিদোয়ান, বুজরুচ, যুবলীগের জসিম, যুবলীগ নেতা সাইফুল, আবদুল আলী, জোবায়েরের নেতৃত্বে চক্র। টেকনাফের নাফ নদ তীরবর্তী দমদমিয়া, নাইটংপাড়া, বরইতলি, লম্বরিঘাট, সাবরাঙ, মুণ্ডারডেইলসহ আরো কয়েকটি নৌঘাটকেন্দ্রিক চক্রও আছে। বিভিন্ন চক্রের সদস্যদের মধ্যে আছে আমির খান, মো. রুবেল, রায়হান বাঙ্গালী, আবু সিদ্দিক, রুহুল আমিন, মো. কাওসার, মো. তাজুল, মো. ফয়সাল, আনোয়ার গনি, আনাস, মো. রফিক, কাউন্সিলর দিল মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, ইয়াসিন। এসব পাচারকারীর মধ্যে মঙ্গলবার নৌবাহিনীর অভিযানে নৌকা থেকে আটকও হয়েছে কয়েকজন। পাচারচক্রের সদস্যদের মধ্যে আরো আছেন মো. জুবায়ের, রুবেল মিয়া, রুবেল আলী, আবদুর রহিম, জসীম উদ্দিন, মো. আব্দুল্লাহ, মো. নুরুল ইসলাম ও রফিক মিয়া।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাকিল আহমদ মানবপাচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গত বুধবার কালের কণ্ঠকে জানান, গত দুই বছর তিন মাসে ১৫৫ জন পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে উদ্ধারও করেছে ৫০০ জন ভিকটিমকে। এ সময়ের মধ্যে পুলিশ মানবপাচারের মামলা রেকর্ড করেছে ৫১টি।